বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪

গার্মেন্টস পণ্যের আড়ালে ৩৭ কোটি টাকার মদ, গ্রেপ্তার ৩

গার্মেন্টস পণ্যের আড়ালে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের এলসি দেখিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হতো বিদেশি মদ। ঢাকায় আনার পর তা মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, রাজধানীর বংশাল ও ওয়ারীতে ওয়্যার হাউসে রাখা হতো। এরপর সুযোগ বুঝে বিপণন করা হতো।

এর পেছনে দায়ী সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আব্দুল আহাদ (২২) এবং তার ভাই মিজানুর রহমান আশিক (২৪)। এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা তাদেরই বাবা মো. আজিজুল ইসলাম। গত এক বছর ধরে তারা মাদক কারবারে জড়িত বলে জানিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

প্রায় ৩৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৩৭ হাজার বোতল বিদেশি মদ ও কোটি টাকা মূল্যের দেশি ও বিদেশি মুদ্রা উদ্ধারসহ শনিবার (২৩ জুলাই) রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে র‍্যাব নাজমুল মোল্লা (২৩) ও সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে (৩৪) গ্রেপ্তার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাদক সিন্ডিকেটটির অন্যতম হোতা আব্দুল আহাদকে রোববার বিমানবন্দর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১-এর একটি দল।

রোববার (২৪ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে  ব্রিফ করেন লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, শনিবার র‌্যাব ১১ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে, শুল্ক-কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে কনটেইনারে মাদকদ্রব্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে।  এ তথ্যের ভিত্তিতে র‍্যাবের একটি দল সেদিন রাত পৌনে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকাগামী মহাসড়কে চেকপোস্ট স্থাপন করে মালবাহী গাড়ি ও কনটেইনার তল্লাশি শুরু করে ।

কমান্ডার মঈন বলেন, সন্দেহভাজন দুটি কনটেইনারে বিদেশি মদ থাকার তথ্য পাওয়ার পর আমরা কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চাই। চট্টগ্রামের কাস্টমস কর্মকর্তারা আসেন। কনটেইনারের দরজা খোলার পর বেড়িয়ে আসে বিপুল পরিমাণ মদের বোতল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাচ্ছিল কনটেইনারটি। ওই কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। এরপর সেখানে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও আসেন। তাদের সবার উপস্থিতিতে রাত সোয়া ১১টার দিকে দুটি কনটেইনারে ৩৬ হাজার ৮১৬ বোতল বিদেশি মদ পাওয়া যায়, যা প্রায় ৩২ হাজার লিটার।

উদ্ধারকৃত মাদকের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য মোট ৩১ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ভ্যাটসহ এর মূল্য ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এটি বিদেশি মদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অভিযান বলেও উল্লেখ করেন তিনি। কমান্ডার মঈন বলেন, অভিযানে গ্রেপ্তার নাজমুল ও সাইফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে একটি নম্বর পাই। ওই নম্বরে তাদের এ মদের চালান ডেলিভারি দেওয়ার কথা। যোগাযোগ করা হলে নম্বরের ওপারের ব্যক্তি (আব্দুল আহাদ) নানাভাবে চেষ্টা করেন, যাতে আমরা জব্দ মালামালগুলো ছেড়ে দিই। এরপর থেকে নম্বরটি বন্ধ।

গ্রেপ্তার নাজমুল ও সাইফুল আরও জানান, বিদেশি মদের বোতলগুলো নিয়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আজিজুল হকের কাছে তাদের যাওয়ার কথা ছিল। বোতলগুলো আজিজুল হকের ছেলে আহাদ ও আশিকের মুন্সিগঞ্জের ওয়্যারহাউজে রাখার কথা ছিল। র‍্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, সেখানে তাদের অনুপস্থিত পাই। এরপর তাদের ওয়ারীর বাসায় অভিযান চালানো হয়। অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ দেশি ও বিদেশি মুদ্রা আটক করা হয়, যার পরিমাণ বাংলাদেশি ৯৮ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ১৫ হাজার ৯৩৫ নেপালি রুপি, ২০ হাজার ১৪৫ ইন্ডিয়ান রুপি, ১১ হাজার ৪৪৩ চায়না ইয়েন, ৪ হাজার ২৫৫ ইউরো, ৭ হাজার ৪৪০ থাই বার্থ, সিংগাপুরের ৯ ডলার ও ১৫ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত।

গ্রেপ্তার আহাদ জানান, তার বড় ভাই আশিক ও পিতা আজিজুল ইসলাম দুবাইগামী একটি ফ্লাইটে চড়ে দুবাই চলে গেছেন। তারও দেশত্যাগের পরিকল্পনা ছিল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, দেশে এ মাদক সিন্ডিকেটের মূলহোতা তার পিতা আজিজুল ইসলাম। অন্যতম হোতা ছেলে মিজানুর রহমান আশিক ও  গ্রেপ্তার আহাদ। দেশের বাইরে থেকে নাছির উদ্দিন নামে একজন পুরো অবৈধ মাদক কারবারটি দেখভাল করেন। তিনি দুবাইয়ে একটি স্বনামধন্য হোটেলে অবস্থান করেন। তার বাড়িও মুন্সিগঞ্জ। নাছিরের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আজিজুল ইসলামের ঠিকানায় বিদেশি মদের বোতলগুলো আসে।

কমান্ডার মঈন বলেন, মিথ্যে তথ্য দিয়ে আমদানি করা মাদকের চালানটি আনায় একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত। আমরা সেটিকে শনাক্ত করেছি। জাফর, শামীম ও রায়হান নামে কয়েকজনের নাম জেনেছি। বিভিন্নভাবে তারা অসৎ উপায়ে বিদেশি মদের বোতল বের করে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। তারা অত্যন্ত অভিনব উপায়ে চালানটি ঢাকায় আনছিল।

তারা মূলত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে গার্মেন্টস পণ্যের কথা বলে এ মদ দেশে নিয়ে আসে। ঈশ্বরদী ও কুমিল্লা ইপিজেডের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি চালানসহ সব কিছু করেছিল। তারা নিজেরাও মোটর বাইক ও পার্স, টিভি-ফ্রিজসহ নানা ব্যবসা করে। বংশাল ওয়ারীতে দোকান রয়েছে। চক্রটি দেশে টিভি ও গাড়ির পার্টস ব্যবসার আড়ালে অবৈধ মাদকদ্রব্য বিপণন করে আসছিল। এর আগেও জানুয়ারি, মার্চ ও মে মাসে আরও তিনটি চালান এসেছে। যেখানে প্রতিবারই প্রায় ১৪ হাজার বোতল বিদেশি মদ আমদানি করে এনেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে গার্মেন্টস পণ্যের আড়ালে আমদানি করা বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ তারা বিক্রি করতেন রাজধানীর নামিদামি সব হোটেল রেঁস্তরা ও ক্লাবে। অবৈধ মাদক বিদেশ থেকে আনার পরে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, রাজধানীর বংশাল ও ওয়ারীতে ওয়্যারহাউসে রাখা হয়। পরে সুবিধাজনক সময়ে এ অবৈধ মাদক বিক্রি করা হতো। ক্ষেত্র বিশেষে পরিবহনকৃত ট্রাক বা কন্টেইনার থেকে সরাসরি ক্রেতাদের নিকট সরবরাহ করে থাকে।

দুবাইয়ে অবস্থানরত নাছির, আশিক ও তার বাবা আজিজুল দাম-দর নির্ধারণ করেন। এ পর্যন্ত তারা মোট চারটি চালান এনেছেন। তারা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করে চালানগুলো নিয়ে এসেছেন।

সাইফুল ও নাজমুলকে আমরা থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।  আজ গ্রেপ্তার আহাদকে থানায় সোপর্দ করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ মিথ্যে ঘোষণায় বিদেশি মদের চালান আনার ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তাদের কোনো যোগাযোগ রয়েছে কি না- জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তাদের স্ক্যানিংয়ে কোনোভাবে এটা এড়িয়ে গেছে। তারা এটি তদন্ত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

তিনি বলেন, আব্দুল আহাদের মূল ব্যবসা ইলেক্ট্রিক পণ্য আমদানি। তার ভাই আশিক ৪/৫ বার ও পিতা আজিজুল ১০/১২ বার দুবাই গেছেন। এ অবৈধ মাদকের চোরাচালানটি মূলত দুবাইকেন্দ্রিক। তাদের নিজস্ব কোনো গার্মেন্টস নেই। তাদের নেই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা। কাস্টমসের কোনো কর্মচারীর যোগসাজশের ব্যাপারে কিছু না বললেও গ্রেপ্তাররা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কথা বলেছে। এ মাদক কারবারে মানি লন্ডারিংয়ের একটি বিষয় আছে। বিষয়টি সিআইডি তদন্ত করতে পারে।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: