শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ইসলাম সেবা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনজুড়ে ছিল ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রভাব। ধর্ম ও ধার্মিকতা তার রক্তে মিশে ছিল। তার পরিবারের মধ্যে সবসময় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আবহ বিরাজ করত। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন একনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সদ্যস্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না, এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’

বঙ্গবন্ধু যুগান্তকারী এ ঘোষণা দিয়ে ইসলামের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। মুসলমানদের ধর্মীয় ভাবাবেগের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে হাইজি, জুয়া, মদ ও ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করেন। সাধারণ মানুষের কাছে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্ব মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব ও অধিকার রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন।বিশ্ব ইজতেমা: ভারতের মাওলানা ইলিয়াছ (রহ.)-এর হাত ধরে বর্তমান প্রচলিত তাবলিগের গোড়াপত্তন হয়। তিনি তাবলিগ শুরু করেছিলেন ১৩৪৫ হিজরিতে। ধীরে ধীরে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। তাবলিগ অনুসারীদের নিয়ে ১৯৪১ সালে দিল্লিতে প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে এর বার্ষিক সম্মেলন হয় ঢাকায়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম, ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ১৯৬৬ সালে ইজতেমা হয় টঙ্গীর পাগার গ্রামে। ওই বছর বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা ইজতেমায় অংশ নিতে শুরু করেন। বড় জায়গার প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গা ইজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এ আন্তর্জাতিক মিলনমেলার জন্য জায়গা বরাদ্ধ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে প্রতিবছর বিশ্ব মুসলমানদের মিলনমেলা বসে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আসেন। তারা ভ্রাতৃত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে জড়িয়ে যান। এটা হজের পর মুসলমানদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তর মিলনমেলা।হাজিদের সম্মান: মুমিন জীবনের সবচে বড় আকাঙ্ক্ষার জায়গা মক্কা-মদিনা। হজ পালন মুমিনের সেরা স্বপ্ন। পাকিস্তান আমলে বাঙালিদের হজে যেতে হতো সরকারকে ভ্রমণ কর দিয়ে। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের ভ্রমণ কর রহিত করেন। শাসকগোষ্ঠীর আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন।

হূদয়ে ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসা: ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষে সমর্থন করেন। এ যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ১ লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী পাঠানো হয়। আরবরা সে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি। ফিলিস্তিন তাদের দখলে চলে যায়। ইসরায়েলিরা জেরুজালেম জবরদখল করে। মসজিদে আকসার ওপর কর্তৃত্ব চালাতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু সবসময় চাইতেন আরবদের বিজয় হোক। মুসলিম উম্মাহর সফলতা আসুক। প্রাণের মসজিদে আকসা মুসলমানদের দখলে থাকুক। ফিলিস্তিন, মসজিদে আকসা ও মুসলিম ভাইদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রেম ফুটে উঠে ১৯৭৪ সালে ওআইসির সম্মেলনে দেয়া ভাষণে। তিনি বলেন, ‘উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সব ধরনের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মতার ওপর জোর দিতে হবে। আমাদের ভাইদের ওপর যে নিদারুণ অবিচার হয়েছে অবশ্যই তার অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরব ভূখণ্ড অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে জেরুজালেমের ওপর। রমজান যুদ্ধের অকুতোভয় বীর শহিদানের প্রতি আমরা সালাম জানাই। তারা তাহাদের শৌর্য ও আত্মত্যাগের দ্বারা বহু অমূলক ধারণা ধূলিস্যাৎ করে এমন একটি নতুন কার্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যাতে এ কথাই মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, ন্যায়বিচার ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয় অবধারিত। আমরা পুরোপুরিরূপে বিশ্বাস করি, ইতিহাস একটি ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। আমরা আমাদের সম্মিলিত ও সুচিন্তিত কার্যক্রম দিয়ে আমাদের ভাইদের ওপর চালিত অবিচারের অবসান ঘটাতে পারব।’ (ইত্তেফাক : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)

ওআইসি ও বঙ্গবন্ধু: মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্যপদ পায় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ওআইসিতে যোগদানের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ওআইসিতে অংশগ্রহণের ফলে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচিতি ও সম্পর্ক গভীর হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে আয়োজিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সম্মেলনে সমকালীন মুসলিম বিশ্বের সমস্যা এবং সম্ভাবনা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু এক যুগান্তকারী বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ়, ঐক্য ও ফিলিস্তিনি মুসলমানদের অধিকারের কথা বলেন। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলেন। তিনি বলেন, ‘ধ্বংস নয় সৃষ্টি, যুদ্ধ নয় শান্তি, দুর্ভোগ নয়, মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা যদি মহানবীর প্রচারিত মানবপ্রেম ও মর্যাদার শাশ্বত মূল্যবোধ আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পারি তাহলে বর্তমানকালের সমস্যা সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এসব মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি। এ সম্মেলন শুধু আরব ভাইদের সংগ্রামের প্রতি সমর্থনে আমাদের ঐক্য সংহত করার জন্যই নয়, বরং জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী শান্তি ও প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে আমাদের একাত্মতা ঘোষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’ (ইত্তেফাক: ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)

রাশিয়াতে তাবলিগ জামাত প্রেরণ: রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম সেখানে তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠে বোঝা যায়, তিনি বিশ্ব মুসলমানের ঐক্য এবং ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে দেখার স্বপ্ন বুকে লালন করতেন।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: