রবিবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

টানা দু’দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার নিম্মাঞ্চল

টানা দু’দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার নিম্মাঞ্চল

প্লাবিত ঃ দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানষ

মুহা: জিললুর রহমান , সাতক্ষীরা ।।

সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে টানা মৌসুমী বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত ১৮ অক্টোবর ভোর ৫ টা থেকে ১৯ অক্টোবর বিকাল পর্যন্ত টানা বর্ষণে সাতক্ষীরা সদর, তালা, কলারোয়া, আশাশুনি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শতাধিক পরিবার। ভেসে গেছে জমির ফসল, আমন ক্ষেত, মাছের ঘের ও পুকুর।

টানা  তিন’দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার সদর উপজেলার ধুলিহর, ফিংড়ি, ব্রহ্মরাজপুর, লাবসা, বল্লী, ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের অধিকাংশ বিলগুলোতে রোপা আমন ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। শতাধিক মাছের ঘের ও পুকুর ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া সাতক্ষীরা পৌরসভার নিম্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও ঘরবাড়িতে পানি উঠেছে। বৃষ্টির কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বিশেষ করে দৈনন্দিন উপার্জনের উপর নির্ভরশীল দরিদ্র পরিবারগুলো নিদারুন কষ্টের মধ্যে পড়েছে।

সাতক্ষীরা পৌর সভার ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাজমুল হোসেন জানান, শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা নদীর নব্যতা হারিয়ে এখন আমাদের মরন ফাদে পড়েছি , নদীর তলদেশ উচ হয়ে যাওয়ায় আমরা দীর্ঘ দিন পানি বন্দি হয়ে পড়েছি । তার ওপর আবার নিন্মচাপের ফলে বাড়ী ছেড়ে ভাড়া বাড়ীতে উঠছি । গত  তিন দিনের  বৃষ্টিতে  তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা পৌর এলাকার পুরাতন সাতক্ষীরা কুলিনপাড়া ,বসতিপাড়া, কামালনগর, ইটাগাছা, খড়িবিলা, বদ্দিপুর কলোনী, শহরতলীর বকচরা, কাশেমপুর, সরকারপাড়া, আমতলার মোড় এলাকা। পানি নিষ্কাষনের কোন পথ না থাকায় বৃষ্টির পানি এসব এলাকার বাড়িঘরে উঠতে শুরু করেছে। সাতক্ষীরা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রাণসায়ের খালও পানি টানতে পারছে না।

শহরতলীর গোপীনাথপুর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম  বলেন, গত প্রায় ২০/২২দিন আগের বৃষ্টিতে পুরো গোপীনাথপুর এলাকার সব বাড়িঘরে পানি উঠেছিল। কয়েকদিন ধর পানি একটু কমলেও গত দুইদিনের টানা বৃষ্টিতে ফের পানি মগ্ন হয়ে পড়েছে পুরো এলাকা। বাড়ির উঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে ঘর থেকে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। বাড়ি থেকে মেইন রাস্তায় যেতে হাটু সমান পানি। পানি না সরায় অনেক কষ্টের মধ্যে আছি আমরা।

ভ্যান চালক মনিরুল ইসলাম বলেন, রোজগার করতে না পারলে সংসার চলে না। গতকাল থেকে টানা বৃষ্টিতে ভ্যান নিয়ে শহরে বের হলেও কেউ ভ্যানে উঠেনি। ফলে খালি হাতেই গতরাতে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছি। আজও ফিস ফিস করে বৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রীরা কেউ ভ্যানে উঠতে চান না। সকলেই ইজিবাইকে উঠে। বৃষ্টির কারনে আমরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছি।

দিন মুজুর শামসুর রহমান বলেন, প্রতিদিন সকালে সাতক্ষীরা শহরের পাকাপুলের মোড়ে গিয়ে কাজের জন্য বসে থাকি। সেখান থেকে কাজের চুক্তিতে বাসাবাড়ি বা ক্ষেত খামরে গিয়ে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। কিন্তু বৃষ্টির কারনে দুইদিন ধরে কেউ কাজে নিতে আসেনি। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছি আমরা।

এদিকে গত ২৭ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত টানা ভারি বর্ষণে সাতক্ষীরা জেলা শহরসহ জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। সে সময় গদাইবিল, ছাগলার বিল, শ্যাল্যের বিল, বিনেরপোতার বিল, রাজনগরের বিল, মাছখোলার বিল সহ কমপক্ষে ১০টি বিলে পানিতে তালিয়ে যায়। এসব বিলের মাছের ঘের ভেসে গেছে। বেতনা নদী তীরবর্তী এই বিলগুলির পানি নদীতে নিষ্কাশিত হতে পারছে না। এই পানি পৌরসভার দিকে এগিয়ে আসছে। অতিবৃষ্টিতে গ্রামাঞ্চলের সব পুকুর পানিতে তলিয়ে গেছে। বেরিয়ে গেছে শত শত টাকার মাছ। এছাড়া কঁাচা ঘরবাড়ি রয়েছে ঝুকির মধ্যে। সবজি ক্ষেত গুলি পানিতে টইটুম্বুর করছে। এখনো পর্যন্ত সে সব এলাকার পানি নিস্কাশিত হয়নি। এসব এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই আবারো গত ২৪ ঘন্টার টানা বর্ষনে সে দুর্ভোগ আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছেন।

এছাড়া তালার ইসলামকাটি, কুমিরা, পাটকেলঘাটা, মাগুরা, আশাশুনির প্রতাপনগর, আনুলিয়া, খাজরা, বড়দল, শ্রীউলা, আশাশুনি সদর, দরগাহপুর, কাদাকাটিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল পানিতে থৈ থৈ করছে। শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, বুড়িগোয়ালিনী, কৈখালি, রমজাননগরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা। কালিগঞ্জ উপজেলার মৌতলা, মথুরেশপুর, ভাড়াশিমলাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের মাছের ঘের ও পুকুর পানিতে ডুবে গেছে বলে খবর দিয়েছেন স্থানীয়রা।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে সোমবার সকাল ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সাতক্ষীরায় ৯১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী দু’দিন এভাবে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলে জানান তিনি। তবে পরশু থেকে বৃষ্টিপাত কমতে পারে।

সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, এই বৃষ্টি ৭১০ হেক্টর আমনের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া ১০২ হেক্টর শাক-সবজির ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য মনে পরশু দিন থেকে বৃষ্টিপাত কমতে পারে। সেক্ষেত্রে এই বর্ষনে কৃষির উপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা পৌর মেয়র তাসকিন আহমেদ চিশতি বলেন , বেতনা নদীর তলদেশ উচ হয়ে যাওয়ায় নদীতে পানি না যাওয়ায় বিস্তর্ীর্ন এলাকা পানি বন্দি হয়ে পড়েছে , পানি বন্দি এলাকার কিছু মাছ চাষি পানির প্রবাহের পথ বন্দ করে মাছ চাষ করছে ফলে জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে । পৌর এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে । বেতনা নদী খনন করলে সাতক্ষীরা বাসী পানি বন্দি থেকে মুক্তি পাবে । 

অন্যদিকে, ঘুর্ণিঝড় ইয়াশের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হওয়া প্রতাপনগর ইউনিয়নের মানুষের দুঃখ কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে টানা বৃষ্টি। এদিকে নদীর পানিতে তলিয়ে রয়েছে পুরো ইউনিয়ন। অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে আরো পানি বেড়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে সেখানকার মানুষগুলো।

প্রতাপনগর গ্রামের নুরুল আফসার জানান, এমনিতেই মানুষ নদীর পানিতে ডুবে আছে। বন্যতলার ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে খোলপেটুয়া নদীর পানি ঢুকে প্রতাপনগর গ্রামে চলছে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা। তার উপর টানা দু’দিনের  অবিরাম বৃষ্টি। এ যেন মড়ার উপর খাড়ার ঘা। প্রতাপনগরের মানুষের দুঃখের যেন আর শেষ নেই।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: