শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

কচুরিপানার বিড়ম্বনায় কাপ্তাই হ্রদে নৌ চলাচল ব্যাহত

স্পেশাল সংবাদদাতা:
রাঙ্গামাটির বিস্তীর্ণ কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানার বিড়ম্বনা বেড়েছে। কচুরিপানার জটলার কারণে হ্রদে মাছ আহরণে বিপাকে পড়ছেন জেলেরা। এছাড়াও নৌ-পথে পর্যটক ও পণ্যবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কচুরিপানাও বেড়ে যায়। জেলায় সর্বমোট ১০টি উপজেলা। এরমধ্যে সাতটি উপজেলা থেকে জেলা সদরে পৌঁছাতে এই নৌপথ ব্যবহার করতে হয়। আর বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলাগুলো থেকে জেলা সদরে যোগাযোগের ক্ষেত্রে নৌ-পথের বিকল্প নেই। তবে নানিয়ারচর ও কাপ্তাই উপজেলায় চলাচলের জন্য সড়কপথও রয়েছে। ৭৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুবিশাল কাপ্তাই হ্রদ জেলার হ্রদনির্ভর উপজেলাগুলোকে ঘিরে রেখেছে। এই হ্রদই এসব উপজেলার অনেক বাসিন্দার জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে বিলাইছড়ি-কাপ্তাই ও সুবলং নৌ-রুটে কচুরিপানার জটলার কারণে বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি, বরকল, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় নৌ-পথে যাতায়াত ও পণ্যপরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। বন্দুকভাঙা, চেঙ্গী চ্যানেল, বেতছড়িসহ বেশ কয়েকটি এলাকার জেলেদের মাছ আহরণ মারাত্মক আকারে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ব্যবসায়ী ও বিএফডিসি।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে বেড়াতে এসেছেন ভ্রমণবিষয়ক ঝটিকা সফর গ্রুপের অ্যাডমিন ও পর্যটক জান্নাতুল ফেরদৌসি মানু। কাপ্তাই হ্রদে কচুরিপানার বিড়ম্বনার কথা তুলে ধরে মানু বলেন, পলওয়েল পার্ক থেকে কাপ্তাই হ্রদের দিকে তাকালে ছোট-ছোট কচুরিপানার জটলা দেখা যায়। এটি পুরো হ্রদের নীল জলরাশির সৌন্দর্য্যকে ম্লান করে দিয়েছে। এছাড়া সুবলং ঝরনা দিকে যাওয়া-আসার পথে লক্ষ্য করেছি, কয়েকটি ট্যুরিস্টবোট কচুরিপানার কারণে আটকা পরে আছে। এ সময় ট্যুরিস্টবোটে থাকা পর্যটক ও তাদের ছোট বাচ্চারা ভয় পাচ্ছিল।

রাঙ্গামাটি পর্যটন ঘাটের ট্যুরিস্টবোট ব্যবস্থাপক মো. রমজান আলী বলেন, প্রতিবছরই কাপ্তাই হ্রদে কম-বেশি কচুরিপানা বেড়ে যায়। তবে এ বছর মাত্রাতিরিক্তভাবে কচুরিপানা বাড়ার কারণে ছোট ট্যুরিস্টবোটগুলো চলাচল করতে পারছে না। আমাদের ট্যুরিস্টবোট ভাড়া বেশিরভাগই হয়ে থাকে সুবলং চ্যানেলে। কিন্তু গত ৪-৫ দিন ধরে সুবলং চ্যানেলে কচুরিপানা এত বেশি জ্যাম লেগেছে যে কোনোভাবেই বোট নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এটার যদি সুরাহা করা না যায়, তাহলে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে রাঙ্গামাটিতে পর্যটন আসলেও হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না।

রাঙ্গামাটি জেলা লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মঈনুদ্দীন সেলিম বলেন, বড় লঞ্চগুলোর যাতায়াত অব্যাহত থাকলেও প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ছোট ও মাঝারি বোটগুলোর খুব সমস্যা হচ্ছে। সুবলং, কাইন্দারমুখ, ফোরেরমুখ এলাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। কচুরিপানা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।

স্পিডবোট যোগে লংগদু উপজেলা হয়ে রাঙ্গামাটি শহরে আসা আরমান খান জানান, সুবলংয়ের পরে কাইন্দারমুখ এলাকাতে কচুরিপানা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে করে ছোট আকারের ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্যুরিস্টবোটের সমস্যা হচ্ছে বেশি। জ্যামে আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে হচ্ছে মানুষকে। স্পিডবোট চলাচলের কোনো উপায় নেই; কিন্তু আমরা একটি লঞ্চের পেছনের পথ ধরে স্পিডবোট নিয়ে এসেছি। তবুও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লেগেছে।

এদিকে গত মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড- এলাকা থেকে কাপ্তাই হ্রদে বেড়াতে এসেছে বিপাকে পড়েন বেশকিছু পর্যটক। বিকেল থেকে হ্রদের মধ্যে কচুরিপানার জ্যামে আটকে পড়ে সন্ধ্যা-ঘনিয়ে রাত হলেও জটলা থেকে রেহাই পাননি। পরে রাতে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ‘৯৯৯’ এ কল দিলে পুলিশ তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে শহরে আনেন। রাঙ্গামাটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ের স্টেশন অফিসার মো. বিল্লাল হোসেন জানান, গত দুই দিনে আমাদের জরুরি কল পেয়ে সুবলং চ্যানেলে গিয়ে দুই দফায় ১৩-১৪টি বোট ও যাত্রীদের উদ্ধার করে আনতে হয়েছে। এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ শহর থেকে এত দূরে গিয়ে রাতে কিংবা ঝড়বৃষ্টি হলে উদ্ধার করাটা কঠিন।

বৃহত্তর কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শুক্কুর বলেন, বৃষ্টিপাত ও উজানের পানি নামার কারণে হ্রদে এখন পানির পরিমাণও অনেক। এখন বাতাসের কারণে কচুরিপানাগুলো এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ায়। যার কারণে সুবলং এর পথে কচুরিপানা জ্যাম লেগে নৌ-চলাচলে ব্যাহত হচ্ছে। তিনি জানান, কচুরিপানার কারণে জেলেরাও ঠিকঠাক মাছ ধরতে পারছেন না। সুবলং, বেতছড়ি, বুড়িঘাট, বন্দুকভাঙাসহ বিভিন্ন এলাকায় কচুরিপানার কারণে জেলেরা মাছের কূপগুলোতে জাল ফেলতে পারছেন না। তাই মাছ আহরণেও ভাটা পড়েছে। এটা নিয়ে কর্তৃপক্ষকে শিগগিরেই ভাবা দরকার।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙ্গামাটি বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, সুবলং এর কাইন্দারমুখ, কাপ্তাই-বিলাইছড়ি রুট ও নানিয়ারচরের চেঙ্গী রুটে কচুরিপানার সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতদিন ধরে কচুরিপানা না থাকলেও হঠাৎ করে বেড়েছে। বিশেষত এসব এলাকায় সেসব জেলেরা কাচকি জাল ফেলে মাছ ধরে থাকেন তাদের এই দুর্ভোগগুলো পোহাতে হচ্ছে। জেলেরা মূলত মাছের কূপ তৈরি করে সেখানে জাল ফেলে মাছ আহরণ করেন। কিন্তু এখন এসব এলাকার বেশিরভাগ কূপেই কচুরিপানার আস্তরণ বিস্তৃত হয়ে পড়ায় মাছ আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। আবার অনেক জেলেই নিজস্ব উদ্যোগে কচুরিপানা অপসারণ করে মাছ আহরণ করছেন; তবে এখানেও বাতাসে সমস্যা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, বিএফডিসির পক্ষ থেকে হ্রদের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া কচুরিপানা অপসারণ করা অনেক কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

জানতে চাইলে কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং রাঙ্গামাটি জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও ভাবছি। শিগগিরই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: