সোমবার, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৪

শেখ রাসেল : ফোটার আগেই ঝরে গেছে যে ফুল

‘আলোকিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নাকি মূর্খতাপ্রসূত পরিসমাপ্তি’ কোনটাকে বেছে নেব, তা নির্ভর করছে আমাদের ওপরেই।’ ‘হ্যাজ ম্যান আ ফিউচার’ গ্রন্থে এমন সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। ব্রিটিশ এ গণিতবিদের নামেই নাম রাখা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তানের।

শেখ রাসেল।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনটা বলেছেন, ‘আব্বা বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে, নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখেন।’

বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো গণিতজ্ঞ হতে চাইতেন কিনা শেখ রাসেল, এ জিজ্ঞাসার মীমাংসা এখন আর সম্ভব নয়, বুঝি। কারণ মাত্র ১০ বছর ১০ মাস বয়সে ইতিহাসের জঘন্যতম ও নির্মমতম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তবে শিশু রাসেল, এমনকি অঙ্কের দুঃখও সইতে পারতেন না। গৃহশিক্ষক গীতালি দাশগুপ্তা যখন বলেছিলেন, অঙ্ক না কষলে ওরা কষ্ট পায়, সঙ্গে সঙ্গে রাসেল দুটো অঙ্ক করে বলেছিলেন, ‘এখন তো আর ওরা রাগ করবে না। এখন তো আর অঙ্কের দুঃখ নাই।’

যিনি অঙ্কের দুঃখের কথা ভাবতেন, মানুষের দুঃখ তাকে কতটা ছুঁয়ে যেত? আজ বেঁচে থাকলে বোঝা যেত ওই দরদিও হৃদয়খানি। অমিত সম্ভাবনার আধার সেই শিশুকে অকালেই বলি হতে হয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর গুপ্তঘাতকদের বুলেট থেকে শেষ রক্ষা পাননি এই ‘অবোধ শিশু’ও। সাংবাদিক বেবী মওদুদ লিখেছেন, সে রাতে বিশ্বাসঘাতক সেনা ‘গুলি ছুড়ে ছোট্ট পাখিটার কণ্ঠ থামিয়ে দিল।’

রাসেল হত্যা ছিল ট্র্যাজেডির ভেতর আরেক ট্র্যাজেডি। তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে ৩২ নম্বর বাড়ির ‘সব কণ্ঠস্বর’ থামিয়ে দিতে চেয়েছিল ঘাতকরা। ওই অপচেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে। রাসেলের ‘হাসুপা’ এখন দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

রাসেল বেঁচে থাকলে আমরা কি তাকে বাংলাদেশের নেতৃত্বে দেখতে পেতাম? আমরা তা জানি না। তবে তারও একটা ‘রাজনৈতিক মন’ ছিল বটে। শেখ হাসিনার লেখায় পাওয়া যায়, বড় কালো পিঁপড়ার কামড়ে আঙুলের রক্ত পড়ার পর ওই ধরনের পিঁপড়াকে দেখলেই রাসেল ‘ভুট্টো’ বলে ডাকতেন। অতটুকু শিশুর কী বোধ, ভাবা যায়!

বঙ্গমাতার দ্বিতীয় কন্যা শেখ রেহানা স্মৃতিলেখায় বলেছেন, বই থেকে একই গল্প পরদিন পড়ে শোনানোর সময় দুয়েকটা লাইন বাদ পড়লে রাসেল ‘ঠিকই ধরে ফেলত এবং বলত কালকের সেই লাইনটা আজ পড়লে না কেন?’ রাসেল ছিলেন এমনই মনোযোগী শ্রোতা। নেতার তো এই বড়গুণ, জনতার কথা মন দিয়ে শোনা।

কারাগারের ‘পাষাণ প্রাচীর’ থেকে বাবাকে ‘মুক্ত’ করতে চেয়েছিল, এমনকি রাসেলের দুই বছরের ‘দুর্বল হাত’, বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আব্বা বালি চলো।’

রাসেল বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকতেন আর হাসতেন, ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গবন্ধু তা লিখেছেন। কিন্তু রাসেল কী বলতে চাইতেন জাতির পিতাকে? রাসেলকে এ রকম সময় বঙ্গবন্ধু বলতেন, অন্যরা ভাববে, ‘একুশ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি নিয়ে কানে কানে কথা বলছি।’

আড়াই বছর বয়সী রাসেল বাবাকে কারাগারে দেখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুরই প্রণীত ছয় দফা শুনিয়েছিলেন। কারাস্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “…ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে— সংগ্রাম, সংগ্রাম— চলবে চলবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন রাসেল। তার গৃহশিক্ষকের ভাষায়— রাসেল ছিলেন ‘মেধা ও মননের অপূর্ব সমাহার।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘ঝরে পড়ে ফোটা ফুল, বেলাশেষে।’ কিন্তু শেখ রাসেল যেন ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া ফুল। উদয়ের আগেই অস্তগত নক্ষত্র এক। ওড়ার আগেই হারিয়ে যাওয়া প্রজাপতি।

রাসেলকে নিয়ে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তুই তো গল্পের বই।’

হ্যাঁ, শেখ রাসেল এক না বলা গল্পের পাণ্ডুলিপি, প্রকাশের আগেই ষড়যন্ত্রের অনলে ছাই হয়ে গেছে যা। না, ‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না’— যেমনটা মনে করেন অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য হারিয়ে যায় কিনা— এ আলোচনায় বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং প্রসঙ্গ টেনে বলেছিলেন, পুড়িয়ে ফেললেও পুস্তকের তথ্য হারিয়ে যায় না। তবে ওই তথ্যের পাঠ উদ্ধার করা কঠিন। কিন্তু অসম্ভব কি?

আগস্টের ওই অমানিশির পর কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের গল্পচরিত্র দুঃখী বালক দুলাল তার বন্ধু রাসেলকে খুঁজতে গিয়েছিল স্কুলে। কিন্তু দেখা পায়নি। আমরাও দুলালের মতো রাসেলকে খুঁজে ফিরি। যদি মেলে, তা হলে কবি অদ্বৈত মারুতের ভাষায়— ‘বলব তোমায় দেখা হলে কত্ত ভালোবাসি, মহান পিতার ছেলে তুমি— তুমি অবিনাশী।’

তথ্যসূত্র

ওয়াসিফ-এ-খোদা, হারিয়ে যাওয়া প্রজাপতি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১২

অজিত দাস, শেখ রাসেল : কুঁড়িতেই ঝরে যাওয়া ফুল। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ, ২০১৬

অদ্বৈত মারুত, রাসেল আমার ভাই। শিশু, অক্টোবর ২০২১, পৃষ্ঠা ৩৪

বার্ট্রান্ড রাসেল, হ্যাজ ম্যান আ ফিউচার। স্পোকসম্যান পিআর, ২০০১

বিডিনিউজ, শিক্ষকের চোখে শেখ রাসেল। বিডিনিউজ, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

বেবী মওদুদ, রাসেলের গল্প। বাংলা একাডেমি, ২০১৩

রোবায়েত ফেরদৌস, তসলিমার ‘ক’ : পাণ্ডুলিপি পোড়ে না। চারদিক, ২০০৪

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাট্যগীতি : মধুঋত্যু নিত্য হয়ে রইল তোমার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলাকা : পলাশের পাতা-ঝরা তপোবনে

শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা। বাংলা একাডেমি, ২০০৭

শেখ হাসিনা, আমাদের ছোট রাসেল সোনা। শিশু একাডেমি, ২০১৮

স্টিফেন হকিং, আমার এই ছোট্ট জীবন (অনুবাদ : জাহাঙ্গীর সুর)। দেশ পাবলিকেশন্স, ২০১৯

সেলিনা হোসেন, রাসেলের জন্য অপেক্ষা। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, ২০১৬



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: