শনিবার, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪

ভারতীয় বিএসএফের বাধায় ঝুলে আছে বন্দরের উন্নয়ন কাজ

ফেনী জেলা প্রতিনিধি: ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর (বিএসএফ) বাধায় ঝুলে রয়েছে ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ। বিএসএফের মতে বিলোনিয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে তার ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সীমান্তের দেড়শ গজের ভেতরে রয়েছে। তাই সেখানে বাংলাদেশ কোনো স্থাপনা নির্মাণ অথবা সংস্কার করতে পারবে না।

তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দাবি, প্রকল্পের ১০ একর জায়গার মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ জায়গা সীমান্তের দেড়শ গজের ভেতরে পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ৪ অক্টোবর দেশের ১৭তম স্থলবন্দর হিসেবে পথচলা শুরু হয় ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরটির। পরশুরাম উপজেলার সীমান্ত এলাকায় স্থাপিত বন্দরটি দেশের একমাত্র রফতানিমুখী বন্দর। ত্রিপুরাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে এটি। এ বন্দর দিয়ে ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর, রড, শুটকি, চুন ও গার্মেন্টস সামগ্রী রফতানি হয়ে থাকে। তবে একমুখী বাণিজ্যের কারণে বন্দরটি অবকাঠামোগত উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে পড়ে।

একপর্যায়ে ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাসদ নেত্রী শিরিন আক্তারের প্রচেষ্টায় বন্দরটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়। পরে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৩৮ কোটি ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘বিলোনিয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন (বিশেষ সংশোধিত)’ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল বন্দরের আশপাশের ১০ একর জায়গায় অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রকল্পটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রকল্পটির কাজ পায় ‘পিবিএল টপ লাইন জিবি’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালের জুন মাসে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ শুরুর তিন বছর শেষ হলেও প্রকল্পটির কাজ মাত্র ২০ ভাগ শেষ হয়েছে। বর্তমানে বিএসএফের বাধার মুখে বাকি কাজ করতে পারছে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। দ্বিপাক্ষিক উচ্চপদস্থ সিদ্ধান্ত না হলে বাকি কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।

ওই প্রকল্পের আওতায় ওয়্যারহাউজ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ওপেন ইয়ার্ড, পার্কিং ইয়ার্ড, ট্রান্সশিপমেন্ট শেড, অফিস ভবন, ব্যারাক, ডরমিটরি, ড্রেন, টয়লেট কমপ্লেক্স, ওয়েব্রিজ স্কেল, পানি সরবরাহ, বৈদ্যুতিককরণ, ওয়াচ টাওয়ার, ফায়ার ফাইটিল স্থাপন কাজ হওয়ার কথা ছিল।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিবিএল টপ লাইন জিবি’র কর্ণধার ফয়সাল হায়দার জানান, প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার জায়গা বিভিন্ন সময়ে মাপ করেছেন। সেই হিসাবে প্রকল্পের আওতায় অন্তত ৭০ ভাগ জায়গা সীমান্তের দেড়শ গজের ভেতরে রয়েছে। এখন ওই জায়গায় কিছু নির্মাণ তো পরের কথা; নির্মাণ সামগ্রীও রাখতে দিচ্ছে না বিএসএফ। বিষয়টি নিয়ে বিজিবি-বিএসএফ কয়েক দফায় বৈঠকে বসলেও ফল পাওয়া যায়নি। নির্ধারিত সময়ে কাজ করতে না পারায় অনেক নির্মাণ সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও কাজ দীর্ঘায়িত হওয়ায় একদিকে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ছে, অন্যদিকে প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তাও বাড়ছে।

তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি মোতাবেক দুই দেশই দেড়শ গজের ভেতরে কাজ করার সম্মতি রয়েছে। এছাড়াও ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের এক সমঝোতা চুক্তিতে ফেনীর বিলোনিয়া স্থলবন্দরসহ ১০টি বন্দরের উন্নয়ন কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সীমানার ১৫০ গজের ভেতর কাজ করার সম্মতি রয়েছে। কিন্তু সেটাও মানছে না বিএসএফ।

বিজিবি ও বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, বিএসএফের বাধার পর বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ কাজের সম্মতি গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে জন্য ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি নৌ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। ওই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে নৌ মন্ত্রণালয় থেকে একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে একটি প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। এর আলোকে চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজিবির মহাপরিচালকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। জিরো পয়েন্টের ১৫০ গজের ভেতর উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণের সম্মতি গ্রহণ করতে ইতোমধ্যে বিএসএফের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিলোনিয়া স্থলবন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ইব্রাহিম ভূঁইয়া জানান, এর আগে বন্দরের নানা সমস্যা নিয়ে বিজিবি-বিএসএফ বৈঠকে সমাধান পাওয়া গেছে। কিন্তু উন্নয়ন কাজের সমাধানের সময় নষ্ট করা অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে না পারায় ঠিকাদার ও বন্দর কর্তৃপক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাহাব উদ্দিন জানান, বর্তমানে প্রকল্পের বাউন্ডারি ওয়াল, কিছু রাস্তা ও ইয়ার্ড নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি ২০-২৫ ভাগের বেশি নয়। বাকি কাজ বিএসএফের বাধার কারণে করা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে বিজিবি-বিএসএফের উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওই বৈঠকের ফলের উপর নির্ভর করছে প্রকল্পের বা অংশের অগ্রগতি।

এ বিষয়ে ফেনীস্থ-৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুর রহিম জানান, বিলোনিয়া স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত স্থানের ৭ একর জিরো পয়েন্টের ১৫০ গজের মধ্যে পড়েছে এমন তথ্য সঠিক নয়, বরং সামান্য জায়গা জিরো পয়েন্টের মাঝে পড়েছে। বিষয়টি সমাধানে উচ্চপদস্থ পর্যায়ে আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করি শিগগিরই এ বিষয়ে বিএসএফের সম্মতি নিয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করা যাবে।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: