রবিবার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৪

পাসপোর্ট করতে পারছেন না ট্রান্সজেন্ডাররা

আমি ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করি, যে কারণে জেন্ডার সচেতনতায় কাজ করা আন্তর্জাতিক এনজিও থেকে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পাই। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় কর্মশালায় অংশ নিতে পারি না।’ কথাগুলো বলেছেন ‘পথচলা ফাউন্ডেশন’র সিইও মানিশা মিম নিপুন।

পাসপোর্ট করতে বাধা কোথায় জানতে চাইলে নিপুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রথমত আমরা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কারণ আমাদের অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। যে কারণে চাইলেও জাতীয় পরিচয়পত্র সংশ্লিষ্ট সেবা নিতে পারি না।’

মানিশা মিম নিপুন বলেন, ‘আমার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। সমস্যাটা হলো জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আমার নামের মিল নেই। আমার নাম মানিশা মিম নিপুন, আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুরু করে সবাই আমাকে এই নামেই চেনে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার নাম মো. জাহিদুল ইসলাম আল আজাদ। আমি চাই মানিশা মিম নিপুন নামেই পাসপোর্ট হোক। সেক্ষেত্রে আমাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। ২০২২ সালে শুরুর দিকে নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছি। কিন্তু কীভাবে পাসপোর্ট করবো, তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’

নিপুনের মতো পাসপোর্ট করতে পারছেন না সুপ্তা আহসান। জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাই পাসপোর্টের আবেদন করতে পারছেন না সুপ্তা।

সুপ্তা আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কিন্তু বাসায় থাকতে পারি না। আমাদের ছোটবেলায় বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয় অথবা বাসা থেকে চলে আসতে বাধ্য হই। আমি ছোটবেলায় বাসা থেকে বের হয়েছি। মা আমাকে বলেছিল, তুমি বাসা থেকে চলে যাও। বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় আমার কাছে জন্মসনদ ছিল না। মা-বাবার পরিচয় দিতে পারছি না। এ অবস্থায় জাতীয় পরিচয়পত্র কীভাবে করবো? কিন্তু এখন আমি বিদেশ যেতে চাই। জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় পাসপোর্ট করতে পারছি না।’

করোনাকালীন টিকা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছেন তারা

সুপ্তার মতো চট্টগ্রামের অধিকাংশ ট্রান্সজেন্ডারের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। যে কারণে পাসপোর্ট তৈরি থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যদিও ২০১৯ সালে স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোটাধিকার পান তারা। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলেও এখন পর্যন্ত তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। কারণ তাদের অধিকাংশের জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় নেই। যে কারণে করোনাকালীন টিকা কার্যক্রমের বাইরে রয়েছেন। জন্মসনদ, বাবা-মায়ের নাম ব্যবহার করার জটিলতার কারণে এখনও তারা জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে পারছেন না।

পথচলা ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চট্টগ্রামে প্রায় তিন হাজার ট্রান্সজেন্ডার আছেন। যাদের প্রায় ৯৫ শতাংশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই।

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মানিশা মিম নিপুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে জেন্ডার বৈচিত্র্য আছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। শুধু ট্রান্সজেন্ডার আছে প্রায় তিন হাজার। এর মধ্যে পথচলা ফাউন্ডেশন এক হাজার ১১২ জনকে সেবা দিচ্ছে। এর বাইরেও নগরীতে আরও অনেকে আছেন। চট্টগ্রামে ঠিক কতজন ট্রান্সজেন্ডার আছে এই তথ্য সমাজসেবা অধিদফতরের কাছেও নেই। যাদের তথ্য আমাদের কাছে আছে, তাদের ৯৫ শতাংশের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। যে কারণে তারা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

জন্মসনদ, বাবা-মায়ের নাম ব্যবহার করার জটিলতার কারণে এখনও তারা জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে পারছেন না

বারবার ওয়ার্ড অফিসে গিয়েও জন্মসনদ নিতে পারেননি রিপন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘গত মাসেও দুবার ওয়ার্ড অফিসে গেছি। সেখানে যাওয়ার পর তারা বলে বিদ্যুৎ বিলের কপি, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র, না হয় জমির দলিল দিতে। তাহলে তারা জন্মসনদ আর কমিশনার সার্টিফিকেট দেবে। এগুলো না থাকলে কোনোভাবে দিতে পারবে না। জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার জন্য এখন আমি বিদ্যুৎ বিলের কপি, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জমির দলিল কোথায় পাবো। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সামাজিক বাস্তবতায় আমরা নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একজন সাধারণ নাগরিক যেসব কাগজপত্র দিয়ে ভোটার হন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও একইভাবে ভোটার হবেন। একটি বিষয় তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা যদি ছেলের রূপ নিতে চান, তাহলে আমরা পুরুষ বিবেচনা করি। মেয়ের রূপ নিতে চাইলে নারী বিবেচনা করি। তবে তাদের ভোটার হতে কোনও ঝামেলা নেই।

তিনি আরও বলেন, ভোটার হতে একজন ব্যক্তির জন্মসনদ, মা-বাবার পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যান অথবা কমিশনারের সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। তাদের ক্ষেত্রেও সেগুলো লাগবে। এগুলো ছাড়া তো আমরা কাউকে ভোটার করতে পারি না। তবে তাদের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিলের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি আমরা।



Comments are Closed

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: